শল্য চিকিৎসা সম্পর্কে ডাক্তার স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের মতামত
স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (1755-1843), হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা, শল্য চিকিৎসার বিষয়ে বেশ স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট মতামত প্রদান করেছেন। যদিও হ্যানিম্যান মূলত ঔষধি চিকিৎসার পক্ষে ছিলেন এবং তার নিরীক্ষা ও দর্শনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথি সৃষ্টির দিকে অগ্রসর হন, তিনি শল্য চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতেন। শল্য চিকিৎসা অর্থাৎ অস্ত্রোপচার তখনকার সময়ে একমাত্র পদ্ধতি ছিল যেটা গুরুতর শারীরিক সমস্যা নিরাময়ে ব্যবহার করা হত। কিন্তু হ্যানিম্যান শল্য চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা ও অপব্যবহার সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
শল্য চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা
হ্যানিম্যানের মতে, শল্য চিকিৎসা ছিল এক ধরনের শেষ ব্যবস্থা যখন প্রাকৃতিক বা ঔষধি উপায়ে রোগ নিরাময় সম্ভব হত না। তার অন্যতম চিন্তা ছিল যে, শরীরে কোনো সমস্যা বা রোগের স্থায়ী সমাধান যদি শুধুমাত্র অস্ত্রোপচার দ্বারা করা হয়, তাহলে তা মূলত সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে কেবল মাত্র সাময়িক উপশম দেবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শল্য চিকিৎসা প্রায়শই রোগের মূল কারণ থেকে সরে গিয়ে শুধুমাত্র বাহ্যিক লক্ষণগুলির প্রতিকার করে। তাই রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করতেন।
হোমিওপ্যাথির উপর গুরুত্ব
হ্যানিম্যান মনে করতেন যে মানবদেহ নিজেই স্বাভাবিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ক্ষমতা রাখে এবং হোমিওপ্যাথি এই প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে। তিনি রোগীর স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতির দিকে জোর দিতেন এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক ও ন্যূনতম মাত্রায় ওষুধ প্রদানের পক্ষে ছিলেন। হ্যানিম্যানের মতে, শল্য চিকিৎসা দেহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে এবং এতে অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
শল্য চিকিৎসার প্রতি মনোভাব
তবে হ্যানিম্যান কখনোই শল্য চিকিৎসা পুরোপুরি বাতিল করেননি। তার মতে, কিছু ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন রোগ অগ্রসর হয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেখানে ঔষধি চিকিৎসা আর কার্যকরী নয়, তখন অস্ত্রোপচারই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, দুর্ঘটনায় গুরুতর আঘাত বা ভাঙা হাড়ের ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসা অপরিহার্য। তবে তিনি মনে করতেন, যতটা সম্ভব অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নয়, বরং ঔষধির মাধ্যমে রোগের নিরাময় করতে হবে।
শল্য চিকিৎসার অপব্যবহার
হ্যানিম্যান শল্য চিকিৎসার অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। তার মতে, অস্ত্রোপচার প্রায়শই অপ্রয়োজনীয়ভাবে করা হয় এবং অনেক সময় তা রোগীর শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করে। বিশেষত, তার সময়ে অস্ত্রোপচারের পরিশীলিত প্রযুক্তি ও সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় সীমিত ছিল, যার ফলে রোগীরা শল্য চিকিৎসার পর নানা ধরনের সংক্রমণ ও জটিলতায় ভুগতেন। তিনি এক্ষেত্রে আরও নিরাপদ ও প্রাকৃতিক উপায় খোঁজার পক্ষে ছিলেন।
আধুনিক শল্য চিকিৎসার প্রসঙ্গে
যদিও হ্যানিম্যানের যুগে শল্য চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা ছিল অনেক বেশি, আধুনিক শল্য চিকিৎসা প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বর্তমানের অত্যাধুনিক অস্ত্রোপচার প্রযুক্তি, সংক্রমণ প্রতিরোধের উন্নত ব্যবস্থা এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হ্যানিম্যানের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত এবং কার্যকর। তবে এখনও তার মতামতের কিছু দিক প্রাসঙ্গিক, যেমন শল্য চিকিৎসার আগে অন্যান্য প্রাকৃতিক বা ঔষধি পদ্ধতির ব্যবহার এবং অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার এড়িয়ে চলা।
উপসংহার
সার্বিকভাবে, ডক্টর স্যামুয়েল হ্যানিম্যান শল্য চিকিৎসাকে প্রয়োজনীয় কিন্তু সীমাবদ্ধ এবং শেষ অবলম্বন হিসেবে দেখতেন। তিনি শল্য চিকিৎসার পরিবর্তে হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে রোগ নিরাময়ের পক্ষে ছিলেন। হ্যানিম্যানের মতে, শল্য চিকিৎসা কেবলমাত্র তখনই ব্যবহার করা উচিত যখন প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ নিরাময় সম্ভব না হয় এবং এটি রোগীর স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতির জন্য ক্ষতিকর না হয়। তার এই দর্শন আজও কিছু ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, যেখানে প্রাকৃতিক এবং ঔষধি চিকিৎসা পদ্ধতিকে শল্য চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রেফারেন্স:
- Hahnemann, Samuel. Organon of Medicine. 6th ed. New Delhi: B. Jain Publishers, 1982.
- Coulter, Harris. Divided Legacy: A History of the Schism in Medical Thought. Vol. 3. Richmond: North Atlantic Books, 1982.
- Ullman, Dana. Discovering Homeopathy: Medicine for the 21st Century. North Atlantic Books, 1991.