চিররোগ কাকে বলে চিররোগের কারণ কি, ওহার চিকিৎসা ও প্রতিকার
চিররোগ: হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিভঙ্গি
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্র অনুসারে, চিররোগ (Chronic Disease) হলো দীর্ঘস্থায়ী, স্বাভাবিক জীবনচক্রের বিপরীত এবং অপ্রাকৃতভাবে শরীরে বিদ্যমান থাকা রোগ। হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে যে, চিররোগ শুধুমাত্র বাহ্যিক উপসর্গ নয়, এটি শরীরের ভেতরের গভীর অস্বাস্থ্য এবং জটিলতাগুলোর ফল। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগকে সামগ্রিকভাবে দেখা হয় এবং রোগের মূল কারণকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
হানেমান, হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর গবেষণায় চিররোগকে তিনটি মিয়াজম বা মূল কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন। এই মিয়াজমগুলি হলো:
- পসোরিক মিয়াজম (Psora): এটি খোসপাঁচড়া বা চর্মরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা শারীরিক এবং মানসিক দুর্বলতার মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত।
- সাইকোটিক মিয়াজম (Sycosis): অতিরিক্ত কোষ বৃদ্ধি এবং সংক্রমণের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
- সিফিলিটিক মিয়াজম (Syphilitic): শরীরে ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া যেমন হাড় ক্ষয়, আলসার ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত।
হোমিওপ্যাথিতে চিররোগের কারণ:
হোমিওপ্যাথিক তত্ত্ব অনুসারে, চিররোগের প্রধান কারণ হল অভ্যন্তরীণ মিয়াজম বা শরীরের গভীর দুর্বলতা। এই মিয়াজমগুলির সক্রিয় হওয়ার ফলে শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়, যা চিরস্থায়ী আকার ধারণ করে। হোমিওপ্যাথিতে চিররোগের কিছু সাধারণ কারণ নিম্নরূপ:
- মিয়াজমের উপস্থিতি: হোমিওপ্যাথিক মতে, মানুষের শরীরে জন্মগতভাবে বা পূর্বের কোনো অসুস্থতা থেকে মিয়াজম তৈরি হতে পারে, যা পরে চিররোগের রূপ নেয়।
- দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ: দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ এবং মানসিক সমস্যা চিররোগের জন্ম দিতে পারে। হোমিওপ্যাথিতে রোগের মানসিক এবং শারীরিক দিকগুলো একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
- আনুসঙ্গিক জীবনধারা: অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন হোমিওপ্যাথির মতে চিররোগের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
- পরিবেশগত দূষণ: হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করা হয় যে পরিবেশে থাকা বিভিন্ন দূষণকারী উপাদান শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং চিরস্থায়ী রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
- জিনগত দুর্বলতা: হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে যে পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত দুর্বলতা বা মিয়াজম শরীরে চিররোগের জন্ম দিতে পারে।
চিররোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগের মূল কারণ (মিয়াজম) নির্ণয় করে এর গভীরে গিয়ে চিকিৎসা করা হয়। উপসর্গের চিকিৎসা নয়, বরং রোগের মূল কারণ দূর করাকেই এখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নিম্নলিখিত কিছু প্রধান হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি চিররোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়:
- মিয়াজম্যাটিক চিকিৎসা: হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে মিয়াজম নির্ণয় করে, তার ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। যেমন, পসোরার জন্য সালফার (Sulphur), সাইকোসিসের জন্য থুজা (Thuja) এবং সিফিলিসের জন্য মেরকিউরাস (Mercurius) প্রয়োগ করা হয়।
- ঔষধের ব্যক্তিগতকরণ: হোমিওপ্যাথিতে প্রতিটি রোগী আলাদা এবং তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্ধারণ করা হয়। উপসর্গ অনুযায়ী নয়, বরং ব্যক্তির সম্পূর্ণ জীবনধারা, মানসিক অবস্থা এবং শরীরের প্রতিক্রিয়া বুঝে ওষুধ নির্বাচন করা হয়।
- মৌলিক উপসর্গের চিকিৎসা: হোমিওপ্যাথিতে মৌলিক উপসর্গগুলির গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এগুলোর ভিত্তিতে রোগের গভীর কারণ খুঁজে বের করে চিকিৎসা করা হয়। রোগীর সামগ্রিক উপসর্গ ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা করা হয়।
- মানসিক চিকিৎসা: মানসিক চিকিৎসা হোমিওপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ মানসিক অবস্থা প্রায়শই চিররোগের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। হোমিওপ্যাথি মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার চিকিৎসার মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
প্রতিকার:
হোমিওপ্যাথি শুধুমাত্র রোগের চিকিৎসা নয়, প্রতিরোধেও বিশ্বাসী। চিররোগ প্রতিরোধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রাকৃতিক ও সুষম খাদ্যগ্রহণ এবং রাসায়নিক মুক্ত খাবার গ্রহণ হোমিওপ্যাথিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- নিয়মিত ব্যায়াম ও বিশ্রাম: হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম জরুরি।
- মিয়াজম শনাক্তকরণ: আগে থেকেই মিয়াজম শনাক্ত করে সময়মতো চিকিৎসা নিলে চিররোগ প্রতিরোধ করা যায়।
- পরিবেশগত যত্ন: স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস করা এবং দূষণমুক্ত পরিবেশে থাকা হোমিওপ্যাথিকভাবে চিররোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
রেফারেন্স:
- Hahnemann, Samuel. The Chronic Diseases: Their Peculiar Nature and Their Homoeopathic Cure.
- Boericke, William. Pocket Manual of Homoeopathic Materia Medica.
- Kent, James Tyler. Lectures on Homoeopathic Philosophy.