ফাইলেরিয়া জ্বর কাকে বলে উহার কারণ কি? উপহার চিকিৎসা ও প্রতিকার
ফাইলেরিয়া জ্বর: হোমিওপ্যাথিক ও অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ
ফাইলেরিয়া জ্বর (Lymphatic Filariasis) হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ, যা মূলত ফাইলেরিয়া পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট হয়। এই পরজীবী সাধারণত মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ফাইলেরিয়া সংক্রমণের ফলে শরীরের লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগীর হাত, পা, অথবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফোলাফোলা হতে পারে, যা হাতি পা রোগ (Elephantiasis) হিসেবে পরিচিত।
ফাইলেরিয়া জ্বরের কারণ
ফাইলেরিয়া জ্বরের প্রধান কারণ হলো ফাইলেরিয়া পরজীবী। এই পরজীবী ওয়ুচেরেরিয়া ব্যাঙ্ক্রফটি (Wuchereria bancrofti) এবং ব্রুগিয়া মালায়ি (Brugia malayi) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। মশাবাহিত রোগ হিসেবে পরিচিত ফাইলেরিয়া রোগ সংক্রমিত মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়।
মুল কারণগুলো:
- ফাইলেরিয়া পরজীবী: ফাইলেরিয়া পরজীবী মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে আক্রমণ করে।
- মশাবাহিত সংক্রমণ: মশা, বিশেষত কিউলেক্স, অ্যানোফিলিস, এবং এডিস প্রজাতির মশা এই রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।
- অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ: মশা জন্মানোর উপযোগী পরিবেশ ফাইলেরিয়া সংক্রমণ বাড়ায়।
- দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ: রোগটির উপসর্গ ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়, এবং সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
ফাইলেরিয়া জ্বরের উপসর্গ
- ফাইলেরিয়া সংক্রমণের ফলে লিম্ফ নোড ফুলে যায়, যা চরম ব্যথা সৃষ্টি করে।
- হাত বা পা ফুলে যাওয়া এবং লিম্ফের তরল জমা হওয়ার ফলে হাতি পা রোগ দেখা দেয়।
- সংক্রমণের পর তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং মাঝে মাঝে উচ্চ জ্বর দেখা দেয়।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ফাইলেরিয়া জ্বরের প্রতিকার
হোমিওপ্যাথিতে ফাইলেরিয়া জ্বরের চিকিৎসা রোগীর লক্ষণগুলির উপর ভিত্তি করে করা হয়। প্রতিটি রোগীর শারীরিক ও মানসিক উপসর্গের উপর নির্ভর করে ঔষধ নির্বাচন করা হয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রধানত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো হয় এবং রোগের মূল কারণের বিরুদ্ধে লড়াই করা হয়।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধসমূহ:
- Calcarea Fluorica: লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে তরল জমা হলে এবং হাতি পা রোগের লক্ষণ দেখা দিলে এই ঔষধ কার্যকর।
- Silicea: শরীরে ফাইলেরিয়া পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণ এবং ফোলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- Arsenicum Album: ফাইলেরিয়া সংক্রমণে দুর্বলতা, পিপাসা এবং চরম ব্যথা হলে এই ঔষধ কার্যকর।
- Graphites: ফাইলেরিয়া থেকে সৃষ্ট ক্ষত এবং চামড়ার সমস্যা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
- রোগীর শারীরিক এবং মানসিক উপসর্গের উপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করা হয়।
- দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ঔষধ ব্যবহৃত হয়।
- রোগের লক্ষণ হ্রাসে উপশমক ঔষধও প্রয়োগ করা হয়।
অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফাইলেরিয়া জ্বরের চিকিৎসা
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতেও ফাইলেরিয়া রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয়। তবে এখানে মূলত পরজীবী ধ্বংসের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা:
- ডাইইথাইলকার্বামাজিন (DEC): ফাইলেরিয়া পরজীবী ধ্বংস করতে ব্যবহৃত প্রধান ঔষধ।
- আইভারমেকটিন (Ivermectin): ফাইলেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- অ্যান্টিবায়োটিক: ফাইলেরিয়া সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়।
- সার্জারি: হাতি পা রোগের চরম অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশ অপসারণের জন্য সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা:
- গিলয় (Tinospora cordifolia): রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।
- ত্রিফলা: লিম্ফ নোডের ফোলা হ্রাসে কার্যকর।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ
- মশা নিয়ন্ত্রণ: মশার জনসংখ্যা কমানো এবং মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা।
- ব্যক্তিগত সুরক্ষা: মশারি ব্যবহার এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা: পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকা এবং মশার জন্মস্থল দূর করা।
বইয়ের রেফারেন্স:
- Organon of Medicine – Dr. Samuel Hahnemann, চিকিৎসার মৌলিক নীতি এবং রোগ নিরাময়ের দিকনির্দেশনা।
- Homeopathic Materia Medica – Dr. William Boericke, ফাইলেরিয়া সংক্রান্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ।
- Harrison’s Principles of Internal Medicine – ফাইলেরিয়া রোগের অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা।